মার্কেটিং-এ এআই এবং অটোমেশনের ব্যবহার
বিগত কয়েক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অটোমেশন প্রযুক্তিটি বিভিন্ন শিল্পে ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়েছে। মার্কেটিংও এর প্রবণতা ব্যতিক্রম নয়। এআই এবং অটোমেশনের উত্থান মার্কেটিং এর কৌশল ও বিস্তারকে আরও দক্ষ এবং ফলপ্রসূ করে তুলেছে।
আমরা আজকে জানবো মার্কেটিং-এ কিছু এআই এবং অটোমেশন স্ট্র্যাটেজিটি ও টুলস নিয়ে। এই স্ট্রাটেজিটি ও টুলস ব্যাবহার করে ছোট বিজনেস গুলোকে বিলিয়ন ডলার এর বিজনেস হতে ভূমিকা রেখেছে।
মার্কেটিং-এ এআই এবং অটোমেশন ব্যাবহার জানার পূর্বে আমাদের জানতে হবে এআই এবং অটোমেশন কী? চলুন ছোট্ট করে তা জেনে নেই।
এআই কী?
এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল মানুষের তৈরী এমন কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সিস্টেম যা মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সেটিকে চিন্তা করার ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা দিয়ে তৈরী করা হয়। যেমন: এআই সিস্টেমগুলি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখতে এবং নতুন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, সমস্যা সমাধান করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে, ভাষা বুঝতে এবং ব্যবহার করতে পারে, এমনকি চিত্রও তৈরি করতে পারে, এছাড়া আরো অ্যাডভান্সড প্রোগ্রামের মাদ্ধমে এআই কে আরো অনেক অনেক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অটোমেশন কী?
অটোমেশন হলো মানুষের সহায়তা ছাড়াই কাজ করার একটি পদ্ধতি। এটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সিস্টেম এর মাধ্যমে কাজ করে। অটোমেশনকে ভিন্ন ভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রয়োজন মত করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অটোমেশন এর মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করা যেতে পারে। যেমন: দৈনন্দিন কাজগুলিকে অটোমেটিক করা, অটোমেটিক সেবা প্রদান করা, বিশ্লেষণ ও তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্ট প্রস্তুত করা, ইত্যাদি।
এখন চিন্তা করুন এআই এবং অটোমেশন এর এই ক্ষমতা গুলো আপনি মার্কেটিং এ কিভাবে কাজে লাগাবেন?
আমরা নিচে বেশ কিছু স্ট্র্যাটেজি লিস্ট তৈরী করেছি। সেগুলো ব্যাবহার করে আপনি আপনার ব্যবসার বিস্তার ঘটাতে পারবেন। চলুন জেনে আসি সেই স্ট্র্যাটেজি গুলো কি।
মার্কেটিং-এ এআই এবং অটোমেশন এর ১০ টি স্ট্র্যাটেজি এবং টুলস
১। চ্যাটবট এবং ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট: চ্যাটবট ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি কাস্টমারকে ২৪/৭ তথ্য সেবা দিতে পারবেন। এটি সাধারণত চ্যাটিং অ্যাপ, ওয়েবসাইট অথবা মোবাইল অ্যাপে ব্যবহৃত হয়।
অন্যদিকে, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট আরও উন্নত ধরনের চ্যাটবট যা আরও জটিল কাজ করতে পারে, যেমন কল করা, ইমেইল পাঠানো বা ক্যালেন্ডার পরিচালনা করা।
ওয়েবসাইটের জন্য পপুলার চ্যাটবট টুলস এর মধ্যে আছে:
২। বিহেভিয়ারাল টার্গেটিং: বিহেভিয়রাল টার্গেটিং হল একটি মার্কেটিং কৌশল যা গ্রাহকদের আচরণের উপর ভিত্তি করে টার্গেট করা হয়।
বিহেভিয়রাল টার্গেটিং কীভাবে কাজ করে?
বিহেভিয়রাল টার্গেটিং সিস্টেমগুলি একজন গ্রাহক ওয়েবসাইটে কীভাবে আচরণ করে তা ট্র্যাক করে। এটি তাদের দেখা পণ্য, ক্লিক করা বিজ্ঞাপন এবং কেনা পণ্যগুলি রেকর্ড করে। এই তথ্যটি ব্যবহার করে গ্রাহকদের পার্সোনালাইজড ইমেইল, এসএমএস পাঠায়, এছাড়াও কাস্টমারকে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দেখায়। স্ট্রাটেজিটি অনেক কার্যকরী কারণ কাস্টমাদের পণ্য কেনার দিকে সাইকোলজিকাল প্রভাব সৃষ্টি করে। তাই এটি ই-কমার্স বিজনেস-এ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া মেটা অ্যাডস, গুগল অ্যাডস বা অন্যান্য অ্যাডস মিডিয়াগুলোতে এটি ব্যাবহার হয়।
কাস্টম কোড এর মাধ্যমে আপনার ওয়েবসাইটে বিহেভিয়রাল টার্গেটিং সেট করতে পারেন। অথবা,
- Segment
- HubSpot Behavioral Targeting
- Omnisend
এই টুলস গুলোর মাধ্যমে পার্সোনালাইজড ইমেইল বা এসএমএস পাঠাতে পারেন।
৩। পার্সোনালাইজড প্রোডাক্ট বান্ডেলস: পার্সোনালাইজড প্রোডাক্ট বান্ডেলস বিহেভিয়রাল টার্গেটিং এর ক্ষুদ্র একটি পার্ট। এই মার্কেটিং কৌশলটি গ্রাহকদের জন্য কাস্টমাইজড পণ্য বা সেবার প্যাকেজ তৈরি করে। এই প্যাকেজগুলি গ্রাহকদের আগ্রহ, পছন্দ এবং কেনাকাটার হিস্ট্রির উপর ভিত্তি করে তৈরি করে।
এই কৌশলটি ই-কমার্স, সাবস্ক্রিপশন বক্স, ট্রাভেল বিজনেস এ বেশ কার্যকরী।
আপনার ওয়েবসাইট যদি ওয়ার্ডপ্রেস এ হয় তাহলে woocommerce প্লাগইন এর মাধ্যমে এটি সেট করতে পারবেন। এছাড়া কাস্টম বিল্ড ওয়েবসাইট গুলোতে কোড এর মাধ্যমে তৈরি করে নিতে পারবেন।
৪। অটোমেটেড কনটেন্ট জেনারেশন: এআই সিস্টেম ব্যবহার করে অটোমেটেড কনটেন্ট তৈরি করা হয়। বর্তমানে এই প্রযুক্তিটি বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট তৈরি করতে পারে, যেমন ব্লগ, সোশাল মিডিয়া পোস্ট, প্রেস রিলিজ, প্রোডাক্ট এর বিবরণ এমনকি কপি রাইটিং ও করা যায়। এর ব্যাবহার দিনে দিনে বেড়েই চলছে কারণ এটি টাইম সেভ করে পাশাপাশি কাজ এর গতি বাড়ায়। তাই এটি ব্যবসা সম্প্রসারণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সব থেকে বেশি ব্যবহৃত কন্টেন্ট জেনারেশন টুলস গুলো হল:
- ChatGPT
- Google Gemini
- Microsoft Copilot
৫। ফ্রড ডিটেকশন: ব্যবসায় ফ্রড ডিটেকশন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে অনলাইন ব্যবসায়। কারণ এই ঘটনা অনলাইন ব্যবসাগুলোতে বেশি হয় এবং এটি দিনে দিনে বাড়ছে।
ফ্রডগুলির মধ্যে সব থেকে কমন হচ্ছে,
বিজ্ঞাপনে কৃত্রিমভাবে ক্লিক করা, ভুয়া লিড তৈরি করা, অবৈধভাবে কুপন কোড ব্যবহার করা, ভুয়া রিভিউ দেয়া, কার্ড ইনফরমেশন চুরি করা, ইত্যাদি।
এই ফ্রডগুলি সকল ব্যবসার জন্য আইডেন্টিফাই করা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ব্র্যান্ড ইমেজকেও ক্ষতি করে।
তবে ফ্রড ডিটেকশন ইমপ্লিমেন্ট করা তুলনামূলক ভাবে একটু জটিল কাজ। এই ফ্রডগুলি থেকে বাঁচতে হলে আপনার ওয়েবসাইট খুব সিকিউর এবং আপটুডেট থাকতে হবে। এর জন্য কিছু অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ব্যবহার করতে পারেন। যেমন: মেশিন লার্নিং, এআই টেকনোলজি। যেটি ওয়েবসাইটের ফ্রড রোধ করতে বহুল বেবহৃত হয়।
৬। ইমেইল মার্কেটিং অটোমেশন: গ্রাহকদের সাথে রেগুলার যোগাযোগ বা ইমেইল মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে ইমেইল অটোমেশন এর বিকল্প নেই। কারণ আপনাকে একজন এর সাথে নয়, প্রতিদিন হাজার হাজার গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। অটোমেশন ছাড়া এই কাজটি আপনার করতে সারাদিন লেগে যাবে যেখানে কিছু টুলস ব্যাবহার করে কয়েক মিনিটে এই কাজ করা যায়।
ইমেইল মার্কেটিং অটোমেশনের জন্য পপুলার কিছু টুলস:
- Mailchimp
- HubSpot
- ActiveCampaign
- MailerLite
- GetResponse
৭। সোশ্যাল মিডিয়া টুলস: বর্তমানে মার্কেটিং এর অন্যতম মাধ্যম হল সোশ্যাল মিডিয়া। এই সোশ্যাল মিডিয়া মধ্যে ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, লিংকডইন, টুইটার অন্যতম। কেমন হয় যদি আপনি একটি টুলস এর মাদ্ধমে সকল প্লাটফর্ম ম্যানেজ করতে পারেন? ব্যাপারটা ভালো হয় না? কারণ এটি আপনার অনেক সময় বাঁচাবে। শুধু তাই নয় এই টুলস গুলোর মাধ্যমে আপনি রিপোর্ট দেখতে পারবেন যেটা আপনার সোশ্যাল মিডিয়া গ্রোথ বাড়াতে হেল্প করবে।
বর্তমানে টপ সোশ্যাল মিডিয়া টুলস গুলো হল:
- Hootsuite
- Buffer
- Sprout Social
- HubSpot
৮। কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট: কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট (সিআরএম) হল একটি ব্যবসায়িক স্ট্রাটেজি যা কাস্টমারের সাথে লংটাইম সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়। এটি কাস্টমারদের সকল তথ্য সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে, বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করে গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা ও মার্কেটিং এর জন্য ব্যবহৃত হয় এছাড়াও এটি কাস্টমারের এক্সপেরিয়েন্স বাড়াতে সহায়তা করে।
বর্তমানে সিআরএম এর জন্য অনেক পপুলার টুলস আছে। যেগুলো ব্যবহার করে ব্যাবসা পরিচালনার সকল কিছু কর যায়। যেমন:
- HubSpot
- Salesforce
- Zoho
- Zendesk
- Pipedrive
৯। পার্সোনালাইজড কনটেন্ট ডেলিভারি: মার্কেটিং অটোমেশনের মাধ্যমে কাস্টমারের আচরণ, পছন্দ, ইত্যাদি রিয়েল-টাইমে ট্র্যাক করে তাদের পছন্দ সাথে মিলে এমন কন্টেন্ট বা পণ্য দেখানো হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটে দেখা যায় যে একটি নির্দিষ্ট পণ্য এর প্রতি আগ্রহ দেখালে ওয়েবসাইট সিস্টেম অটোমেটিক্যালি ঐ পণ্য এর ভিন্ন ব্র্যান্ড বা ক্যাটাগরি সাজেস্ট করে। সুতরাং আপনি এমন একটি অটোমেশন সেট করে রাখবেন যেটি এই কাজটি অটোমেটিক্যালি করতে থাকবে।
ফেসবুকে এই অটোমেশনটি অনেক দেখা যায়। যেমন: একজন ইউজারকে তার পছন্দ হবে এমন কন্টেন্ট দেখায় যার কারণে ইউজার অনেক সময় ধরে ফেসবুক ব্যবহার করে থাকে।
বেষ্ট পার্সোনালাইজড কনটেন্ট ডেলিভারি সফটওয়্যার এর মধ্যে এগিয়ে আছে।
- Oracle Marketing
- Adobe Experience Cloud
- DynamicYield
- OptinMonster
- Insider
এছাড়াও, আপনার ব্যবসা যদি বড় স্কেল এর হয়ে থাকে তাহলে কাস্টম কোড দিয়ে পছন্দ মোতাবেক পার্সোনালাইজড কনটেন্ট ডেলিভারি সিস্টেম বানিয়ে নিতে পারেন।
১০। লিড স্কোরিং এন্ড নার্চারিং: অন্য দিকে লিড স্কোরিং হল সম্ভাব্য গ্রাহকদেরকে স্কোর দেয়া। এই স্কোরটি দেয়া হয় গ্রাহকের আচরণ, ডেমোগ্রাফিক তথ্য এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর। উচ্চ স্কোরযুক্ত লিডের পণ্য ক্রয় করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অন্যদিকে, লিড নার্চারিং হল একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সম্ভাব্য গ্রাহকদের বিভিন্ন মার্কেটিং কেম্পেইন এর মাধ্যমে তাদের পণ্য ক্রয় করানো হয়। এতে বিভিন্ন ধরনের মার্কেটিং কন্টেন্ট ব্যবহার করা হয়, যেমন ইমেইল, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, এবং ওয়েবিনার।
লিড স্কোরিং এবং নার্চারিং মডেল তৈরী করতে আপনার প্রয়োজন পরবে ভালো একটি সিআরএম টুলস এর।
লিড স্কোরিং এবং নার্চারিং এর জন্য সেরা সিআরএম হল:
- HubSpot
- Salesforce
- Zoho
- Zendesk
মার্কেটিং-এ এআই এবং অটোমেশন ব্যবহারের চ্যালেঞ্জগুলি কী কী?
মার্কেটিং-এ এআই এবং অটোমেশন ব্যাবহারে বাস্তবিক অর্থে অনেক সুবিধা আছে, তবে এর কিছু পারস্পারিক দিকও আছে। যেমন:
নিরাপত্তা: যেহেতু এই স্ট্রাটেজি গুলোতে অনেক থার্ড পার্টি টুলস এর ব্যবহার রয়েছে তাই ডেটা নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে।
এআই বায়াসড: এআই মডেলগুলিকে ডেটা দিয়ে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় সেভাবে কাজ করে, ফলে ডেটা যদি বায়াসড হয় তাহলে মডেলটিও বায়াসড ফলাফল দেবে। তার মানে এটি যদি ভুল ভাবে প্রোগ্রাম করা হয় এটি ভুল ফলাফল দিবে।
জটিলতা এবং ব্যয়বহুল: এই সিস্টেমগুলো ইমপ্লিমেন্ট করা তুলনামূলক জটিল কাজ, যার ফলে এটি ব্যয়বহুল।
পরিশেষে: মার্কেটিং অটোমেশন এর চ্যালেঞ্জগুলি খুব সহজেই মোকাবেলা করা সম্ভব। একজন এক্সপার্ট রেভঅপস (RevOps) স্ট্রাটেজিস্ট বা দক্ষ মার্কেটিং এজেন্সি হায়ার করার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করতে পারেন। এছাড়াও মার্কেটিং অটোমেশন ইমপ্লিমেন্টশন-এ সবথেকে ভালো সিদ্ধান্ত হল সিআরএম (CRM) এক্সপার্ট হায়ার করা। এতে আপনার ব্যবসার মার্কেটিং-কে এবং সেলস প্রসেসকে অন্য লেভেলে নিয়ে যেতে পারেন।
মার্কেটিং অটোমেশন সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে আমাদের এক্সপার্ট এর সাথে নিচে দেয়া লিংকে গিয়ে ফ্রি মিটিং বুক করতে পারেন।