ব্র্যান্ডিং এবং মার্কেটিং এর আদ্যোপান্ত
ব্র্যান্ডিং এবং মার্কেটিং, এই দুইটি শব্দ আপনি উদ্যোক্তা এবং মার্কেটারদের কাছ থেকে প্রায়শই শুনে থাকবেন।
তবে সত্য বলতে ব্র্যান্ডিং এবং মার্কেটিং এ আপনার ধারণার চেয়ে আরও অনেক কিছু রয়েছে। ছোট করে বললে, ব্র্যান্ডিং আপনার ব্যবসার স্থায়ী এবং ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করে। অন্যদিকে মার্কেটিং হলো আপনার পণ্য এবং সার্ভিস প্রচার করার একটি উপায় যেটা আপনার পণ্যের বিক্রি বাড়াবে।
বর্তমানে, ব্যবসার সাফল্যের চাবিকাঠি হল শক্তিশালী একটি ব্র্যান্ড তৈরি করার পাশাপাশি বিভিন্ন মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি এপ্লাই করা, যা আপনাকে ব্যবসা বাড়াতে সাহায্য করবে।
তো চলুন ব্র্যান্ডিং এবং মার্কেটিং সমস্ত কিছু নিয়ে জেনে নেই।
ব্র্যান্ডিং কী?
ব্র্যান্ডিং মূলত হলো একটি মার্কেটিং প্র্যাকটিস যার মাধ্যমে একটি কোম্পানি তার পন্য, বা সেবার মাধ্যমে নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তোলে এবং তাদের প্রতিযোগীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি আইডেন্টিটি তৈরি করে। আরো সহজ করে বললে কোম্পানির নাম, লোগো, কোম্পানি ট্যাগলাইন, ইত্যাদি এর পরিচিতি ক্রেতার কাছে তুলে ধরার প্রক্রিয়া হল ব্র্যান্ডিং।
আপনি একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন আপনার পরিচিত অনেকেই বলে থাকে যে:
সে Honda চালায়।
আবার কেও কেও বলে আমি Coke খাবো!
অথচ Honda এবং Coke দুটোই ব্র্যান্ড এর নাম। মানুষজন বাইক না বলে হোন্ডা বলে, কোল্ড ড্রিংকস না বলে কোক বলে, সুতরাং এই কোম্পানিগুলো এমন ভাবে তাদের পণ্যর প্রচার করেছে যে মানুষজন পণ্যর নামকে তাদের ব্র্যান্ড নাম ধরে ডাকে। আসলে ব্র্যান্ডিং গোল এমনটাই হওয়া উচিৎ।
সাধারণত ৬ ধরনের ব্র্যান্ডিং হয়ে থাকে:
১। কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং: কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং এর মাধ্যমে একটি সংস্থার নাম, লোগো, মূল্যবোধ, মিশন এবং ভিশন সব মিলিয়ে একটি পরিচয় তৈরি করে। যেমন, গুগল, মাইক্রোসফ্ট এই ধরনের ব্র্যান্ড।
২। পারসোনাল ব্র্যান্ডিং: একজন ব্যক্তির পেশাগত জীবনে তার নিজস্ব কোন গুণকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে তৈরি করাই হল পারসোনাল ব্র্যান্ডিং। এই ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির নামই হবে ব্র্যান্ড নাম। যেমন: বিখ্যাত বক্তা, লেখক বা উদ্যোক্তা।
৩। প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডিং: কোন একটি নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য একটি ভিন্ন পরিচয় তৈরি করাই হলো প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডিং। এটি পণ্যের নাম, লোগো, প্যাকেজিং এবং মার্কেটিং কৌশলের মাধ্যমে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোকাকোলা, আইফোন, ইত্যাদি।
৪। রিটেইল ব্র্যান্ডিং: রিটেইল ব্র্যান্ডিং হল দোকান বা শপিং মলের জন্য আলাদা পরিচয় তৈরি করা। এটি দোকানের ভিতরের ডিজাইন, প্রোডাক্ট, এবং কাস্টমার সার্ভিস এই সব কিছুর মাধ্যমে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, স্বপ্ন, মিনা বাজার, ইত্যাদি।
৫। জিওগ্রাফিক ব্র্যান্ডিং: জিওগ্রাফিক ব্র্যান্ডিং হল কোন দেশের নির্দিষ্ট কোনো একটি অঞ্চল বা শহরকে তার বিশেষ কিছু জিনিস এর জন্য সারা বিশ্বে পরিচয় তৈরি করা। এটি পর্যটন, খাদ্য, এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, দুবাই, সিঙ্গাপুর।
৬। সার্ভিস ব্র্যান্ডিং: সেবার মাধ্যমে নিজেদের বিজনেস বা প্রোডাক্ট এর একটি ভিন্ন পরিচয় তৈরি করা। এটি সার্ভিস এর মান, এবং কাস্টমার এর আস্থা এর মাধ্যমে করা হয়। যেমন: ফেডেক্স।
মার্কেটিং কী?
মার্কেটিং হল একটি স্ট্র্যাটেজি যার মাধ্যমে আমরা টার্গেটেড কাস্টমারকে পণ্য কেনানোর জন্য উদবুদ্ধ করার চেষ্টা করি। পণ্যের মান, বৈশিষ্ট, কেন এই পণ্যটি ক্রেতার জন্য উপকার হবে, বাজারে অন্য ব্র্যান্ড এর একই পণ্যে পাওয়া গেলেও আমাদের টা কেন কিনবে, ইত্যাদি বার্তা পৌঁছানোই মার্কেটিং এর মূল উদ্দেশ্য, এবং এই মার্কেটিং এক্টিভিটিস এর মাধ্যমে আমরা কাস্টমারকে পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করি।
তো আমরা বলতে পারি, প্রোডাক্ট এর সেল বাড়ানোর জন্য আমাদের যে সকল কাজ করি তা হচ্ছে মার্কেটিং।
মার্কেটিং ৩ ধরনের হয়ে থাকে:
১। ট্রেডিশনাল মার্কেটিং
২। ডিজিটাল মার্কেটিং
৩। ওয়ার্ড অফ মাউথ মার্কেটিং
কোনটি আগে - ব্র্যান্ডিং নাকি মার্কেটিং?
অবশ্যই ব্র্যান্ডিং আগে। কারণ আপনার স্টার্টআপ হোক বা রেস্টুরেন্ট, আপনাকে আগে মানুষ জনের কাছে নিজেকে পরিচিত করতে হবে। চিন্তা করুন আপনার ব্যবসার যদি কোন নাম বা পরিচিতি না থাকে তাহলে মানুষজন কি উদ্দেশ্যে আপনার আছে আসবে? তো মানুষজন যদি না চিনে তাহলে আপনার থেকে কেও পণ্য কিনবে না। সুতরাং সর্বপ্রথম আপনাকে আপনার ব্র্যান্ড এর নাম, লোগো, ট্যাগলাইন, স্থান, ইত্যাদি এর মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং শুরু করতে হবে। এরপরে আপনি মার্কেটিং শুরু করবেন। সময়ের সাথে মার্কেটিং কৌশল পরিবর্তন হবে তবে ব্র্যান্ডিং একই থাকবে।
কিভাবে ব্র্যান্ড তৈরি করবেন?
ব্র্যান্ড তৈরির আগে প্রথমে আপনাকে এমন একটি পণ্য বা সার্ভিস বের করতে হবে যেটি মানুষের প্রতিনিয়ত কাজে লাগে।
সঠিক পণ্য বাছাই করার উপায়:
১। ডিমান্ড অ্যানালাইসিস: কোন জিনিস এর চাহিদা বাজারে বেশি সেটি বের করা।
২। অডিয়েন্স অ্যানালাইসিস: কারা আপনার সার্ভিস ব্যাবহার করবে তাদের ব্যাপারে অ্যানালাইসিস করা।
৩। কম্পিটিটর অ্যানালাইসিস: আপনার কম্পিটিটররা মার্কেটিং এর জন্য কি কি করছে সেটা যাচাই করুন।
আপনার যদি পণ্য থেকেও থাকে, তবুও আপনি এসব অ্যানালাইসিস করে রাখতে পারেন। এগুলো আপনার মার্কেটিং এও সাহায্য করবে।
ব্র্যান্ড তৈরির ক্ষেত্রে যে জিনিস গুলো মাথায় রাখবেন:
১। আপনার ব্র্যান্ড কে অন্য ব্র্যান্ড থেকে আলাদা রাখতে আপনার পণ্যর কিছু বিশেষত্ব রাখবেন। কারণ পণ্য একই রকম হলে অন্য পণ্য রেখে গ্রাহকরা আপনার পণ্য কিনতে দ্বিধা করতে পারে।
২। কাস্টমারের সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে, মনে রাখবেন গ্রাহকরা সন্তুষ্ট হলে তারা আপনার ব্র্যান্ড সম্পর্কে অন্যদের কাছে বলবে এবং এটা আপনার ব্র্যান্ড ভ্যালু এবং সেল বাড়বে।
৩। একটি কার্যকর প্ল্যান রেডি করুন এবং এটি ধরে আগাতে থাকুন। যেমন: আপনার বিজনেস প্লানিং এর পর সেটি কিভাবে এক্সেকিউট করবেন তার একটি কমপ্লিট প্ল্যান রেডি করা। একটি ক্লিয়ার প্ল্যান থাকলে আপনার সময় বেঁচে যাবে।
৪। নিয়মিত কাস্টোমার দের থেকে ফিডব্যাক নিন, সে অনুযায়ী আপনার পণ্য বা সেবার মান বাড়ান। কাস্টোমার দের সন্তুষ্ট রাখাই আপনার ব্যবসায়ের মূল চাবিকাঠি।
ব্যবসা বাড়াতে ১০টি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি
ব্র্যান্ড নিয়ে তো অনেক কিছু জানলাম, চলুন এখন আমরা কিছু মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে জানি।
১। কন্টেন্ট মার্কেটিং: কাস্টমারকে আপনার বিজনেস এর সাথে এনগেজ রাখতে হাই কোয়ালিটি কন্টেন্ট তৈরি করুন। কন্টেন্ট গুলো সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ভিডিও প্লাটফর্ম, ইত্যাদি মিডিয়াতে রেগুলার পোস্ট করুন।
২। সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন: আপনার ওয়েবসাইট এর সার্চ র্যাঙ্কিং সবার উপরে রাখতে এটি অনেক গুরুত্বপূর্ন।
৩। সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং: টপ সোশ্যাল (ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, ইত্যাদি) প্লাটফর্ম গুলোতে এক্টিভিটিস বাড়াতে হবে। এটি অনলাইনে আপনার ব্র্যান্ড ভিজিবিলিটি বাড়াবে।
৪। ইমেইল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন: ইমেইল সাবস্ক্রাইবার লিস্ট তৈরী করে ইমেইল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালান, এর জন্য ইমেইল অটোমেশন টুলস যেমন হাবস্পট, মেইলচিম্প, ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। অটোমেশন টুলস নিয়ে ৭ এবং ৮ নম্বর টপিকে আরো বিস্তারিত শেয়ার করবো।
৫। পেইড অ্যাডভার্টাইজিং: পেইড অ্যাডভার্টাইজিং ক্যাম্পেইন ভালো ভাবে সাজাতে পারলে অনেক অল্প সময়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এখন সব থেকে বেষ্ট পেইড অ্যাডভার্টাইজিং প্লাটফর্ম গুলো হল গুগল, ফেইসবুক ও ইউটিউব (যদিও প্লাটফর্ম গুলো আপনার প্রোডাক্ট ধরণ এর উপর ডিপেন্ড করে) এই প্লাটফর্ম গুলোতে টার্গেটেড অ্যাডস রান করুন।
৬। ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং: আরো বড় অডিয়েন্সকে টার্গেট করতে এটি বেশ কার্যকরী। এছাড়া আপনার পণ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে এই স্ট্র্যাটেজিটি অনেক কাজে দিবে।
৭। কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট (CRM): আপনার কাস্টমারের পছন্দ, ইন্টারঅ্যাকশন ও যে কোনো তথ্য এক সাথে রাখতে CRM টুলস আপনাকে হেল্প করবে। যখন আপনার কাস্টমারের সব তথ্য আপনার কাছে থাকবে তখন আপনি খুব সহজেই তাদের টার্গেড করে ইফেক্টিভ মার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালাতে পারবেন, শুধু তাই নয় CRM এর মাধ্যমে আপনার বেশির ভাগ কাজ ওয়ার্কফ্ল এর মাধ্যমে অটোমেটিক করতে পারবেন। আপনার যদি CRM নিয়ে কোন হেল্প লাগে তাহলে আমাদের সাথে এখনি একটি ফ্রি মিটিং বুক করতে পারেন।
৮। অ্যানালিটিক্স এন্ড ট্র্যাকিং: আপনার ওয়েবসাইট এর ভিজিটর সংখ্যা থেকে শুরু করে অ্যানগেজমেন্ট, ইউজার এর বিহেভিয়ার, মার্কেটিং ক্যাম্পেইন পারফরম্যানস, ইত্যাদি জানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এই সকল ডাটা দিয়ে আপনার কোন মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ঠিক ভাবে কাজ না হয়ে থাকলে অ্যানালিটিক্স এর মাধ্যমে জানতে পারবেন এবং সেটি ঠিক করতে পারবেন। এর জন্য আপনি গুগল অ্যানালিটিক্স অথবা CRM টুলস যেমন হাবস্পট ব্যবহার করতে পারেন। হাবস্পটের সুবিধা হল এখানে আপনি পেইড মার্কেটিং থেকে শুরু করে ট্র্যাকিং সমস্ত কিছু এক জায়গায়তে করতে পারবেন।
৯। এফিলিয়েট মার্কেটিং: এফিলিয়েট মার্কেটিং হলো একটি অন্যতম কার্যকর মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। যখন আপনার কাস্টমার একটি নির্দিষ্ট লিংক অথবা চ্যানেল এর মাধ্যমে আরেক জন কাস্টমার নিয়ে আসবে তখন সে কিছু কমিশন বা রিওয়ার্ড পাবে। এই রিওয়ার্ড সিস্টেম থাকার কারণে এটি বেশ সফল একটি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি।
১০। পাবলিক রিলেশনস (PR): বিভিন্ন ইভেন্ট এ আপনার বিজনেস এর বেপারে শেয়ার করুন, টিভি বা প্রেস মিডিয়াতে আপনার ব্র্যান্ড এর নিউজ বা তথ্য কভার করুন।
একজন উদ্যোক্তা হতে কিংবা অনলাইনে আপনার ব্যবসা বাড়াতে দরকার সময় এবং কঠোর পরিশ্রম, যখন আপনি সময় নিয়ে এই ব্র্যান্ডিং এবং মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি গুলো সঠিক ভাবে ইমপ্লিমেন্ট করতে পারবেন তখন আশা করা যায় আপনার সফলতা এবং ভালো ফলাফল শুধুমাত্র সময় এর ব্যাপার।